জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী উৎসব–ভাবনা কেমন হবে

নিউজ ডেস্ক | /BUSINESSTIMES24.NET

প্রতিবেদন প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, সময়ঃ ১১:২০


জুলাই গণ–অভ্যুত্থান সবকিছুকেই আমাদের নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। উৎসব-ভাবনাকেও নতুনভাবে ভাববার দরকার আছে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্ষেপে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব, যেন আগামিতে প্রয়োজনে আরও বিস্তারিত লিখতে পারি।

উৎসব সম্পর্কে আমাদের প্রথম পাঠ এই যে ‘জাতীয় উৎসব’ নামের ধারণা বাদ দিতে হবে। এর কারণ আমরা জাতিবাদের যুগ পার হয়ে এসেছি। সেক্যুলার কিংবা ধর্মীয় সব প্রকার জাতিবাদ আমাদের যেভাবে বিভক্ত করে রাখে, বিরোধ তৈরি করে, তাতে বিশ্বব্যবস্থায় শক্তিশালী অবস্থান আদায় করে নেওয়া আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না।

আমরা বাস করছি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালপর্বে। যারা মার্ক্সের দুই-এক পাতা উল্টিয়ে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক প্রচণ্ড গতিশীল। মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে বাজারের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন প্রবলভাবে উৎসাহিত করে, তেমনি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির প্রণোদনাকেও প্রবলভাবে উৎসাহিত করে।

স্বাধীন ব্যক্তির এই উত্থান ও শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অ্যাবসার্ড, মার্ক্সের ভাষায় প্রতিক্রিয়াশীল। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিকাশ একটি সমাজে ঘটা শুরু হলে তার বিরুদ্ধে নানা প্রতিক্রিয়াশীল ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধারণাও প্রবল হয়। যাঁরা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না, তাঁরা ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’-এর শেষে যুক্ত ‘প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র’ অধ্যায় পড়ে আসতে পারেন। আমাদের জেনারেশনের বিপ্লবী তরুণদের বিশাল একটি অংশ অকাতরে যে ‘সমাজতান্ত্রিক’ স্বপ্নের জন্য শহীদ হয়েছেন, জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাঁদের করুণ ইতিহাস শুনলে মার্ক্স ও এঙ্গেলস আফসোস করতেন।

এটা সেই সময়, যখন পাশাপাশি আমরা প্রবল জাতিবাদীও হয়ে উঠেছিলাম। আমরা মেনে নিতে চাইনি যে ভাষা ও সংস্কৃতি যেমন আমার অস্তিত্বের অংশ, তেমনি আমাদের ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ, গ্রহ–নক্ষত্রের সঙ্গে বিশেষ সম্বন্ধের ধরনও একান্তই আমাদের। কিন্তু আমরা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধর্মের বিপরীতে স্থাপন করেছি, আবার উল্টো দিকে ধর্মকে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছি। দুই প্রকার জাতিবাদের জন্ম দিয়েছি আমরা। একদিকে সেক্যুলার জাতিবাদ, আর তার বিপরীতে ধর্মীয় জাতিবাদ। এর জন্য আমাদের অতীতে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এখনই সাবধান না হলে সামনে আরও মূল্য দিতে হবে।

পুঁজির আত্মস্ফীতি ও বিচলনের জগতে ‘জাতিবাদ’ নয়, আমাদের দরকার নতুন ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী’ হিসেবে নিজেদের কল্পনা করতে ও ভাবতে শেখা। কেন? যেন পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় আমরা আমাদের জন্য শক্ত একটা আসন আদায় করে নিতে পারি। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান আমাদের বৈশ্বিকভাবে ভাবার তৌফিক দিয়েছে।

নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে ভাববার অর্থনৈতিক মর্ম হচ্ছে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দ্রুত শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা। কিন্তু সেটা রাজনৈতিকভাবে নতুন ও শক্তিশালী বাংলাদেশ গঠন ছাড়া সম্ভব নয়। তাই জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক মর্ম হচ্ছে গণসার্বভৌমত্বের (Peoples’s Sovereignty) ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। এই আলোকে আমরা চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে উৎসব নিয়ে দুয়েকটি কথা পেশ করছি।

উৎসব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক তৎপরতা
সরকার এবার চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ একসঙ্গে পালন করার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করেছে। সমাজে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ যখন ঘটে, তখন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব ব্যক্তিকে তার সামষ্টিক বোধ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে গণ-উৎসব বা যেকোনো সামাজিক মিলনমেলা ব্যক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে সামাজিক বা সামষ্টিক বোধ উপলব্ধির শর্ত তৈরি করে। একে অনেকে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বলছেন।

কিন্তু জুলাই গণ–অভ্যুত্থান মূলত ছিল ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপের লড়াই। ফলে অন্তর্ভুক্তির নামে যেকোনো প্রকার ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বা ফ্যাসিস্ট শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা নীতি হতে পারে না। সেই জন্যই ‘জাতিবাদ’ বা যেকোনো পরিচয়সর্বস্বতা সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিভিন্ন, বিচিত্র ও অনেককে নিয়েই আমরা ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী’ হয়ে উঠি। কারণ, বিশ্বসভায় আমরা আমাদের স্থান নিশ্চিত করতে চাই। সেটা রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়।

এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির মূল্য বুঝতে জালাল উদ্দীন খাঁর বিখ্যাত গান মনে পড়ছে—‘এ বিশ্ববাগানে সাঁই নিরঞ্জনে মানুষ দিয়া ফুটাইল ফুল’। আমাদের গণ-উৎসব হবে মানুষের উদ্‌যাপন। আগামী দুনিয়ায় ‘বিশ্ববাগান’-এর রূপ কেমন হতে পারে, বাংলাদেশে তার রূপ আমাদের হাজির করে জগৎকে নতুন দুনিয়ার আগমনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।


Editor: Rafiq Uzzaman

Executive Editor: Dr. Abu Sayeed

Address:

42/1-KA, Shegunbagicha, Ramna, Dhaka, Bangladesh

© dinajpurnews24.com ২০২৫ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।